অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুর থেকেঃ মাছঘাটে চাঁদাবাজী, ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানি হচ্ছে পাইকাররা। কমিশনের নামে নিরবে চাঁদাবাজী চলছে মাটঘাটসমূহে। কোথাও অভিযোগ দিয়েও উপকার পাননি বলে এখন আর বলতে চান না তারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। এদিকে প্রশাসনের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ঘটনাটি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনাপড়ের মাছ ঘাটের।
জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনাপাড়ের ৯টি মাছঘাটে চাঁদার শিকার হচ্ছেন জেলেরা। ঘাটের আড়তে মাছ বিক্রির কমিশনের নামে শতকরা ৮ টাকা করে রশিদ ছাড়া এ চাঁদা আদায় করছেন ঘাটের মালিক পক্ষের নিয়োজিত লোকজন। নিজেদের নামে পরিচিতি ঘাটগুলোর স্থানীয় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ নেতারা ভাগাভাগি করে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ কারণে কোনো জেলে ভয়ে ‘রা টু’ শব্দও করার উপায় নেই।
এদের মধ্যে কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বছরে ৫শ’ দিয়ে একটি মাছের আড়তের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই এসব করে যাচ্ছেন। এ কারণে যেমন জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমিন সরকারও রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। দাদনের বেড়াজালে আবদ্ধ বহু জেলে ঘাটগুলোতে মাছ বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ঘাটগুলোতে মেঘনায় মাছ ধরতে আসা রায়পুর, লক্ষ্মীপুর সদর, ভোলা, বরিশাল, শরিয়তপুর ও চাঁদপুরের বহু জেলে মাছ বিক্রি করে থাকেন। ঘাটগুলো সরেজমিন ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের মাছঘাটগুলো হলো চর জালিয়ার গ্রামে সাইজুদ্দিন মোল্লা মাছঘাট, চর ইন্দুরিয়া আলতাফ মাষ্টারের মাছঘাট, আলতাফ মাষ্টারের বাহিরের ঘাট, পুরান বেড়ি মাছ ঘাট, দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের হাজীমারা মাছঘাট, পানিরঘাট মাছঘাট, মিয়ারহাটে রাহুল মাছঘাট, টুনুর চরে দিদার মোল্লার মাছঘাট। এগুলোর মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাষ্টারের মালিকানায় উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশীতে ৪টি।
পুরানবেড়ির ঘাটটিতে মাষ্টারের সঙ্গে আলাদা টেবিল রয়েছে আওয়ামীলীগ নেতা খালেদ দেওয়ান, ওসমান খানের টেবিল, আওয়ামীলীগ নেতা মফিজ খাঁনের টেবিল, রতন হাওলাদারের টেবিল, বাচ্চু খাঁনের টেবিল। উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইজ উদ্দিন মোল্লা ও আওয়ামীলীগ নেতা বাবুল সরদারের মালিকানায় একটি। দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মনির হোসেন মোল্লা ও সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন মোল্লার মালিকানায় পৃথক দু’টি মাছঘাট রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল রাহুলের মালিকানাধিন নতুন মাছঘাট ও যুবলীগ নেতা দিদার মোল্লার মালিকানাধীন টুনুরচরে মোল্লা মাছঘাট।
জেলে আঃ হক মাঝি, আমিন উদ্দিন বেপারী, রফিজল হক, আয়নাল খান, জাহাঙ্গীর পাইক ও দুলাল ছৈয়াল বলেন, আমরা কষ্ট করে নদীতে ভিজে, পুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরি। সেই মাছ বেচতে আসলে উল্টো বিনা রশিদে আমাদের কাছ থেকেই শতকরা ৮ টাকা করে কেটে রাখা হয়। আমরা দাদন না নিলেও বাধ্যতামূলকভাবে কমিশনের নামে টাকা দিতে হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে উল্টো মার খেতে হবে।
আলতাফ মাষ্টার ঘাটের কর্মচারী জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রায় একশ’ জেলের কাছে আমাদের ৮০ লাখ টাকার মতো দাদন রয়েছে। তাঁরাই আমাদের এখানে মাছ বেচতে আসেন। তাদের কাছ থেকে আমরা ৮টাকা করে কমিশন নেই। একই সাথে তাঁরা বিনা সুদে দাদন নেওয়া টাকা ধীরে ধীরে জমা করেন। দাদন নিয়ে অনেক জেলেই আর আসেন না। এভাবে আমাদের প্রায় ২০ লাখ টাকা তাঁরা মেরে দিয়েছেন।
উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, রায়পুর উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা সংখ্যা ৭ হাজার ৫শ’। এদের মধ্যে জাটকা জেলে বা নদীর উপর নির্ভরশীদের মধ্যে রয়েছেন ৬ হাজার ৮শ’ ৫০ জন। ঘাটগুলোতে মৎস্য অফিসের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি নেই।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোঃ ইউসুফ হোসেন জানান, এ ইউনিয়নে ৬ জনের নামের মাছের আড়তের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। ৫শ’ টাকা করে ফি জমা দিয়ে এক বছরের জন্য এ লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরমধ্যে আলতাফ মাষ্টারের নামে ৪টি, রতন হাওলাদার ও বাচ্চু খাঁনের নামে একটি করে লাইসেন্স রয়েছে। অন্য কারো নাম এখানে নিবন্ধিত নেই।
দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব তছলিম উদ্দিন জানান, আমার ইউনিয়নে ৪টি মাছঘাট থাকলেও কোনো ব্যক্তি এখন পর্যন্ত মাছের আড়তের জন্য ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেননি।
মনির হোসেন মোল্লা বলেন, আমিসহ ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতি ও সম্পাদকসহ ৬ জন পানিরঘাট চালাই। এঘাটে আগের মত জেলেরা আসে না। প্রায় শতাধিক জেলে এঘাটে শতকরা ৫ টাকা করে দিয়ে থাকেন।
সাইজ উদ্দিন মোল্লা বলেন, আমি, চরভৈরবীর আওয়ামীলীগ নেতা রুহুল আমি মেম্বার ও শিল্পপতি শওকত আলী বাবুল মিলে ঘাটটি চালাই। ঘাটে আগত মাছ বিক্রয়কারী জেলেদের কাছ থেকে শতকরা ৮ টাকা করে কমিশন নেওয়া হয়। এখন আগের মতো জেলেদের সমাগম নেই।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাষ্টার আলতাফ হোসেন হাওলাদার বিএসসি বিষয়টিতে কোনো সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়ে বক্তব্য দেবেন না বলে জানান।
রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল জলিল বলেন, এ ধরণের ঘটনা কেউ আমাদেরকে জানায়নি। বিষয়টি যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরীন চৌধুরী বলেন, জেলেদের কাছ থেকে মাছ বিক্রি বাবদ টাকা আদায়ের বিষয়টি জানা নেই। বিষয়টিতে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রায়পুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ বলেন, অবৈধ মাছঘাটগুলোর কারণে সরকারের জাটকা নিধন প্রতিরোধ ও মা ইলিশ রক্ষা আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়। ইজারার আওতায় না থাকায় সরকারও রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলেরা। দলীয় পদবী বা প্রভাব খাটিয়ে কাউকে এ ধরণের মাছঘাট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় দল নিবে না।