করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারির অন্যতম কারণ হলেও প্রায় দু’বছর ধরে লকডাউন, স্থিতিশীলতা, বেড়ে যাওয়া, কমে যাওয়াসহ নানা প্রভাব কাটিয়ে উঠলেও নানা খাতে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে কঠিন বিপথের দিকে। করোনাভাইরাসের দুর্যোগে সকল খাত নিয়ে বিবেচনা, সুবিবেচনা করা হলেও কেনো জানি করোনা নামক ভাইরাসের অভিশাপ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা কিবা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের তারিখ পেছাতে পেছাতে এ পর্যন্ত কতোবার যে তা পেছালো তার হিসেব আর নেই। খোদ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও রাখেননি। শিক্ষার্থীদের বিপথে ঠেলে দিতে শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা নাজুক করে তোলা হয়েছে।
করোনা অজুহাতে দেশে কোন খাতটি বন্ধ আছে? কল-কারখানা, মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ, অফিস-আদালত, যানবাহন গাড়ি-ঘোড়া, আকাশপথ, নৌপথ, কোনোটাই বন্ধ নেই। মুখে মুখে লকডাউন, কাগজে-কলমে লকডাউন ঘোষিত হলেও বাস্তবায়নে তা চোখে পড়ে না। দেশে কতোগুলো খাত লকডাউন ও ছুটি বা বন্ধের আওতায় আনা হয়েছে? কেবল মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো খাতে কার্যকর হয়নি এতো দীর্ঘ সময় ধরে।
এতো লম্বা সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে শিক্ষার্থীরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তারা বিভিন্ন রকম বিপথে চলে গেলো। শতকরা ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে ঝরে গেলো অকালে। ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী নেশাসহ বিভিন্ন খারাপ কাজে জড়িয়ে গেলো। ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কাজে লেগে গেলো। বিপথগামী হলো ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী, বিভিন্ন ধরনের মোবাইল খেলা যেমন পাবজি, ফ্রী ফায়ার, তাস, লুডু সহ নানা নেশাযুক্ত খেলায় আচ্ছন্ন হলো ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদক, চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। বড়ো দুঃখের বিষয় এসব শিক্ষার্থীদের আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
করোনা প্রকোপ চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা না যাওয়ায় কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও তা অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে এবং শিক্ষার্থী ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের বেত হাতে, চোখরাঙানি, নাম ধরে সতর্ক করার মতো ক্লাস করে মনোযোগ ধরে রাখতে শিক্ষকরা হিমশিম খেতো, সেখানে ভার্চুয়াল ক্লাস অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনযোগ কিভাবে অটুট রাখবে? মানে ফলাফল ছিলো শুন্য। অনলাইন ক্লাস ব্যর্থ।
শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে মন্ত্রী, সচিব, উপসচিব, সহকারি সচিব, ডিজি,এডিজি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেট ভরিয়ে লাভ কি! অযথা বরাদ্দ না দেয়ার জন্য সরকারের সুবিবেচনা করা উচিত। কারন এখন তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। তাহলে এসব টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়া ছাড়া আর কাজ কি!
শিক্ষার্থীদের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে গো-খানা, ডাস্টবিনে রূপান্তর করে, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শিক্ষকরা দেদারছে বেতন-ভাতা, ঈদ বোনাস ঘরে বসে তুলছেন। গোঁফে তেল দিয়ে সুখী জীবনযাপন করছেন শিক্ষকরা। তারা যে শিক্ষক এটাও তারা বেমালুম ভুলে গেছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে শিক্ষকদের কোনো রা টু শব্দ নেই। যদি প্রতিষ্ঠান বন্ধের সাথে সাথে শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হয়ে যেতো তাহলে এতোদিন দেশে শিক্ষকরা বহু কর্মসূচি দিতো ও আন্দোলন সংগ্রাম করতাম।
শিক্ষকদেরও সিংহভাগ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়েছেন। কারণ আর কি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ গরুর খড়-কুটা রাখে, গরু বাঁধে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে শাকসবজি করে। কোথাও কোথাও পুরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন লতাগুল্মে ঢেকে গেছে। শিক্ষকদের কোনো মাথাব্যথা নেই এই নিয়ে। তাদের তো আর ভাষণ দিতে হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের আরও ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে প্রমোশন নামক অটো পাশ দিয়ে। পড়ালেখা না করে, পরীক্ষা না দিয়ে, অটো উপরের ক্লাসে তুলে দিয়ে তাদের ধ্বংসের সীমায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এরকম সিদ্ধান্ত সরকার কার পরামর্শে, কি কারনে নিয়েছে তা বোধগম্য নয়। পড়ালেখা নেই, পরীক্ষা নেই, শিক্ষা মূল্যায়ন না করে, কিভাবে- কি করে অটো পাস করে দিলো তা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভালো জানেন।
স্বাস্থ্য বিধি মেনে দেশের সকল খাতই খুলে দেয়া হয়েছে। তবে কেনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে? দীর্ঘসময়ের দোলাচালে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে! পড়ালেখা থেকে দূরে চলে গেছে! পড়াশোনার গতি হারিয়েছে, মেয়েদের কারো কারো বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেদের অনেকেই নানা সমস্যার সাথে জড়িয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। ক্রমান্বয়ে বিবাদ ও বিষাদে নিপতিত হচ্ছে, অর্থাভাব ও ব্যক্তিগত সমস্যা, হতাশা, পারিবারিক ঝামেলা এবং সামাজিক অস্থিরতার প্রভাবে অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনে ঘটেছে অশান্তি।এদের কেউই আর পড়াশোনার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না।
চোখের সামনে একটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে, একটা সম্ভাবনাময় প্রজন্ম মানসিকভাবে যে চরম ভঙ্গুর ও দুর্দশায় নিপতিত হচ্ছে, সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই! উল্লেখযোগ্যভাবে- প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক পরিকল্পনায় দ্বিধা, সময়োচিত পদক্ষেপ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, সর্বোপরি অনুভূতির জায়গাগুলো খুবই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ, মানবিক শব্দটি অধরা, সাহস কথাটি অপরিচিত এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সততা প্রশ্নবিদ্ধ!
সকল দিক বিবেচনা করে প্রজন্ম ভবিষ্যতকে রক্ষা করতে, আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্র সেনাদের ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক।
লেখক কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
সম্পাদকঃ আবীর আকাশ জার্নাল