ঢাকা ০৬:২৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
সমাজ পরিবর্তনে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম। স্কানথর্পের নব নির্বাচিত এমপির সাথে নর্থ বাংলা প্রেসক্লাবের মতবিনিময়। স্কানথর্পের নব নির্বাচিত এমপির সাথে নর্থ বাংলা প্রেসক্লাবের মতবিনিময়। ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনার এর সাথে নর্থ বাংলা প্রেসক্লাবের সৌজন্যে সাক্ষাৎ যুক্তরাজ্যের নর্থ-বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ফখরুল হোসাইনের সাথে বিশ্বনাথ মডেল প্রেসক্লাবের মতবিনিময় নর্থ বাংলা প্রেসক্লাব নর্থ বাংলা প্রেসক্লাব ইউকের আত্মপ্রকাশ, সভাপতি ফখরুল হোসাইন সম্পাদক নুরুল আমিন ৪০ কেজি ওজনের হলি রামাদ্বান ফ্যামেলি ফুড প্যাক বিতরণ করল আননিয়ামাহ উইমেন্স এডুকেশন ট্রাস্ট ইউ কে যুক্তরাজ্যের উইলশ্যায়ার কাউন্টির ডেপুটি লেফট্যানান্ট হলেন বিশ্বনাথের মাকরাম আলী আফরুজ যুক্তরাজ্যের উইলশ্যায়ার কাউন্টির ডেপুটি লেফট্যানান্ট হলেন বিশ্বনাথের মাকরাম আলী আফরুজ

ঘুম ভাঙানিয়া কবি আল-মাহমুদ।

রাজধানী ঢাকা থেকে দীর্ঘদিন ‘নোঙ্গর’ নামের মাসিক ম্যাগাজিন করেছি। যার সর্বশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল ২০০৮ সালের শেষের দিকে। তৎসময়ে ম্যাগাজিনে তখনকার হিতৈষী যশস্বী মনীষী যাঁরা ছিলেন (এখনো যাঁরা আছেন) তাদের অপ্রকাশিত লেখার জন্য হন্যে হয়ে ছুটতাম। কবি আল মাহমুদের লেখা ও একটা সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য নয়াদিগন্ত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক কবি জাকির আবু জাফর এর শরণাপন্ন হলাম। তিনি কবি আল মাহমুদের ঠিকানা দিয়ে বলেছেন- ‘প্রয়োজনে যেন জাকির আবু জাফর এর নাম বা নয়া দিগন্তের রেফারেন্স দেই।’ কবি আল মাহমুদের পোস্ট অফিস রোডের বাসার গেটে সত্যিই এতে উপকার হয়েছে। এজন্য কবি জাকির আবু জাফর অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আগে থেকেই অনুমতি ছিল যে শুক্রবার আমাদের জন্য নির্ধারিত সময়। কাছ থেকে দেশ প্রধান কবিকে দেখবো তীব্র মানসে শুক্রবার সকালেই তৈরি হয়ে ছুটলাম আর কোন যোগাযোগ ছাড়াই। সিকিউরিটি বাসায় ফোন দিয়ে কবি আল মাহমুদের অপিনিয়ন নিয়ে তবেই উপরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আমার সাথে ছিল সহকর্মী ফারুক হোসেন শিহাব।
সিঁড়ির সামনে অতিথিদের জন্য রাখা সোফায় বসলাম। কেউ একজন এসে পরিচয় নিয়ে গেলেনন। দু তিন মিনিটের মধ্যে চেক লুঙ্গি সাদা ফতুয়া পরা কবি এসে সামনে হাজির। বুকের ভেতর টিপটিপ করছে, এত বড় কবি, এত জ্ঞানীগুণী কবি, যার কবিতা দেশ-বিদেশের কোটি কোটি পাঠক লুফে নিয়েছে,​ পাঠ্যপুস্তকে শিশু-কিশোররা পড়ে সে কবি মুহূর্তে সামনে এসে হাজির!
পাশে বসলেন সোফায়। কবি বললেন-‘ সকালে আকস্মিক নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।শরীরটা তেমন ভালো নেই।আসার সময় যদি কল করে আসতেন, তাহলে হয়তো বারণ করতাম।’ বলেই ভেতরের দিকে গেলেন। আমরা দুজনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলাম।
আমাদের অবাক করে দিয়ে কবি সাদা বাঘা বাঘা পেয়ালা ভরে রং চা বিস্কিট ভর্তি টে হাতে হাজির। দেখে নিজেরা খুব লজ্জিত হলাম। এত বড় মাপের কবি’র কাছে লেখা নিতে এসেছি শূন্য হাতে, আহা কি বোকা! কি বোকা!
লজ্জার জাল ছিন্ন করে কবি পশ্চিম মাথায় জানালার পাশের সোফায় আমাদের নিরিবিলি নিয়ে বললেন- ‘সাক্ষাৎকার নিতে প্রশ্ন নিয়ে এসেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে বলেছি -‘ জ্বী না।’ কবি অবাক করে দিয়ে বললেন তাহলে কি মুখস্থ সাক্ষাত্কার নিবেন? বললাম স্যার, ও তেমন নয়। এই তো জানার ভেতরের অজানা গোটা চারেক প্রশ্ন হবে। কবি বললেন -‘জ্বী, শুরু করুন।’
তারপর এক এক করে ১৭/১৮ টি প্রশ্ন তোলা হলো, উত্তর নেয়া হলো, অপ্রকাশিত কবিতা সংগ্রহ হলো। নোঙ্গর প্রকাশিত হওয়ার পর কপি সযত্নে কবি’র হস্তগত করা হলো। দেখলাম কবি কত সাদা চামড়ার সাদা মনের মানুষ, কইতরের পায়ের মতন লাল ঠোঁটের কবি, সোনালী কাবিনের কবি,মায়ের নোলকের কবি আল মাহমুদকে এত কাছে এত আন্তরিকতায় পেয়ে যেন স্বপ্নের রাজকুমার এসে ধরা দিল আমাদের কাছে। ঠিক এমনটি মনে হয়েছিল।
জ্ঞানতাপস বিজ্ঞজনেরা এমনই হওয়া উচিত। কবি আল মাহমুদের আচার-আচরণ শারীরিক ভাষা এত সাধারন আন্তরিক যে সফলতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে যেন কবি আরও নমনীয় আবেগপ্রবণ শিশুসুলভ হয়ে উঠেছেন। সত্যিই এমন ব্যবহারে আন্তরিকতায় আমরা ধন্য। কবি আজ আমাদের মাঝে নেই। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে কবি’র জন্য দরখাস্ত রইল যেন কবি সুখে থাকেন।
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি ‘সোনালি কাবিন’ খ্যাত কালজয়ী কবি আল মাহমুদ। সাহিত্যে নিজের অমরতা নিশ্চিত করে বসন্ত-ভালোবাসার আবেশ গায়ে মেখে তিনি​ ১৫ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিয়েছেন এ পৃথিবী থেকে। তিনি আর কখনো আসবেন না লোকালয়ে, অমর একুশে বইমেলায়। আসবেন না সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আশীর্বাদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য কবি আল মাহমুদ। পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত সাহিত্যের সব্যসাচী কবি আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, আত্মজীবনী ইত্যাদি। এ যাবৎ তার প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’।
বাংলা কবিতায় গ্রামীণ এবং নাগরিক চেতনার মিশেলে এক নতুন ধারা রচনা করে গেছেন আল মাহমুদ। ছন্দের চালে কীভাবে আধুনিক হৃদয়কে বশ করতে হয় তা শিখিয়ে গেছেন তিনি। তার কিশোর কবিতা আবহমান বাংলাকাশে চিরকাল শিশির হয়ে ঝরবে।’
‘আল মাহমুদ শনাক্ত হয়েছেন তার কবিতায়। চর্যাপদের কাল থেকে প্রকৃত কবিরা যেভাবে শনাক্ত হয়ে এসেছেন কালে কালে তিনিও সেভাবেই শনাক্ত হয়েছেন এবং কালের অমর পাতায় তার কীর্তি লিপিবব্ধ হয়ে থাকবে সোনালী কালিতে এটাই বাস্তব।’
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’। এর তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আরো দু’টি কবিতার বই ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’। এর মধ্যে ‘সোনালি কাবিন’ তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এ ছাড়া তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ তার উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপা হওয়ার কারণে ফেরারি হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথেও।
নিজের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা রচনা করে গেছেন কালজয়ী দু’টি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’।
তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রাক্তন এই সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক সহায়তায় যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে।
সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আল মাহমুদ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ উল্লেখযোগ্য। নিজের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির কারণে আল মাহমুদ জীবনব্যাপী মানুষের হৃদয়ে আর ইতিহাসের শিলালিপিতে যে অমরতা পেয়েছেন, কোনো স্বীকৃতিই তার সাথে তুল্য নয়।
আল মাহমুদ প্রাণহীন হলেও নিজ কীর্তির কারণে প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে আছেন। প্রভাতফেরি, আধফালি চাঁদ, নারী, নিসর্গ, ফুল-পাখি বা খড়ের গম্বুজের আড়ালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে। আর খুঁজলেই পাওয়া যাবে তার কবিতা ও বই।
আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়। বাংলা ভাষা এবং বাংলা কবিতা যতদিন থাকবে ততদিন শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে ‘সোনালী কাবিনের’ কবির নাম। কবির দীর্ঘ স্মৃতিপট বেঁচে থাকার এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তার উত্তরসূরি কবিরা। অভাববোধ করেন অনুজ স্নেহের কবি’রা। স্মরণসভা, জন্মদিনসভা কবিতা আড্ডা দিয়ে কবিকে জিইয়ে রাখার চেষ্টায়,মগ্ন তারা।
‘আল মাহমুদ কবিতার মানুষ ছিলেন। তার কাছে কবিতাই ছিল মুখ্য। রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন এটা সত্য তবে তিনি চিরকালই তার কবিতার আদর্শে অটুট ছিলেন। যে কবি যত বেশি আলোচনায় থাকেন তিনি তত বেশি সফল।’
‘কোনো বিভাজন কবিকে স্তব্ধ করে রাখতে পারে না। একজন কবি’র যাত্রা কাল এবং সময়কে অতিক্রম করে এগিয়ে চলে অনন্তের পথে। আল মাহমুদ সেই যাত্রী যিনি শেষ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন তার কবিতা দিয়েই, অন্য কিছু দিয়ে নয়।’ কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, ‘আল মাহমুদ সহজ সরল শব্দ এবং বাক্য দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে তাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব বিভাজন থাকলেও ওপার বাংলায় তিনি এককভাবে উচ্চারিত। এটাই কবি আল মাহমুদের সাফল্য।’
শুভ কামনা কবি।অনন্ত জীবনে সুখে থাকুন।
অ আ আবীর আকাশ: লেখক কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
সম্পাদক: আবীর আকাশ জার্নাল
ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

সমাজ পরিবর্তনে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম।

ঘুম ভাঙানিয়া কবি আল-মাহমুদ।

আপডেট সময় ০৯:০৪:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জুলাই ২০২০
রাজধানী ঢাকা থেকে দীর্ঘদিন ‘নোঙ্গর’ নামের মাসিক ম্যাগাজিন করেছি। যার সর্বশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল ২০০৮ সালের শেষের দিকে। তৎসময়ে ম্যাগাজিনে তখনকার হিতৈষী যশস্বী মনীষী যাঁরা ছিলেন (এখনো যাঁরা আছেন) তাদের অপ্রকাশিত লেখার জন্য হন্যে হয়ে ছুটতাম। কবি আল মাহমুদের লেখা ও একটা সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য নয়াদিগন্ত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক কবি জাকির আবু জাফর এর শরণাপন্ন হলাম। তিনি কবি আল মাহমুদের ঠিকানা দিয়ে বলেছেন- ‘প্রয়োজনে যেন জাকির আবু জাফর এর নাম বা নয়া দিগন্তের রেফারেন্স দেই।’ কবি আল মাহমুদের পোস্ট অফিস রোডের বাসার গেটে সত্যিই এতে উপকার হয়েছে। এজন্য কবি জাকির আবু জাফর অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আগে থেকেই অনুমতি ছিল যে শুক্রবার আমাদের জন্য নির্ধারিত সময়। কাছ থেকে দেশ প্রধান কবিকে দেখবো তীব্র মানসে শুক্রবার সকালেই তৈরি হয়ে ছুটলাম আর কোন যোগাযোগ ছাড়াই। সিকিউরিটি বাসায় ফোন দিয়ে কবি আল মাহমুদের অপিনিয়ন নিয়ে তবেই উপরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আমার সাথে ছিল সহকর্মী ফারুক হোসেন শিহাব।
সিঁড়ির সামনে অতিথিদের জন্য রাখা সোফায় বসলাম। কেউ একজন এসে পরিচয় নিয়ে গেলেনন। দু তিন মিনিটের মধ্যে চেক লুঙ্গি সাদা ফতুয়া পরা কবি এসে সামনে হাজির। বুকের ভেতর টিপটিপ করছে, এত বড় কবি, এত জ্ঞানীগুণী কবি, যার কবিতা দেশ-বিদেশের কোটি কোটি পাঠক লুফে নিয়েছে,​ পাঠ্যপুস্তকে শিশু-কিশোররা পড়ে সে কবি মুহূর্তে সামনে এসে হাজির!
পাশে বসলেন সোফায়। কবি বললেন-‘ সকালে আকস্মিক নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।শরীরটা তেমন ভালো নেই।আসার সময় যদি কল করে আসতেন, তাহলে হয়তো বারণ করতাম।’ বলেই ভেতরের দিকে গেলেন। আমরা দুজনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলাম।
আমাদের অবাক করে দিয়ে কবি সাদা বাঘা বাঘা পেয়ালা ভরে রং চা বিস্কিট ভর্তি টে হাতে হাজির। দেখে নিজেরা খুব লজ্জিত হলাম। এত বড় মাপের কবি’র কাছে লেখা নিতে এসেছি শূন্য হাতে, আহা কি বোকা! কি বোকা!
লজ্জার জাল ছিন্ন করে কবি পশ্চিম মাথায় জানালার পাশের সোফায় আমাদের নিরিবিলি নিয়ে বললেন- ‘সাক্ষাৎকার নিতে প্রশ্ন নিয়ে এসেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে বলেছি -‘ জ্বী না।’ কবি অবাক করে দিয়ে বললেন তাহলে কি মুখস্থ সাক্ষাত্কার নিবেন? বললাম স্যার, ও তেমন নয়। এই তো জানার ভেতরের অজানা গোটা চারেক প্রশ্ন হবে। কবি বললেন -‘জ্বী, শুরু করুন।’
তারপর এক এক করে ১৭/১৮ টি প্রশ্ন তোলা হলো, উত্তর নেয়া হলো, অপ্রকাশিত কবিতা সংগ্রহ হলো। নোঙ্গর প্রকাশিত হওয়ার পর কপি সযত্নে কবি’র হস্তগত করা হলো। দেখলাম কবি কত সাদা চামড়ার সাদা মনের মানুষ, কইতরের পায়ের মতন লাল ঠোঁটের কবি, সোনালী কাবিনের কবি,মায়ের নোলকের কবি আল মাহমুদকে এত কাছে এত আন্তরিকতায় পেয়ে যেন স্বপ্নের রাজকুমার এসে ধরা দিল আমাদের কাছে। ঠিক এমনটি মনে হয়েছিল।
জ্ঞানতাপস বিজ্ঞজনেরা এমনই হওয়া উচিত। কবি আল মাহমুদের আচার-আচরণ শারীরিক ভাষা এত সাধারন আন্তরিক যে সফলতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে যেন কবি আরও নমনীয় আবেগপ্রবণ শিশুসুলভ হয়ে উঠেছেন। সত্যিই এমন ব্যবহারে আন্তরিকতায় আমরা ধন্য। কবি আজ আমাদের মাঝে নেই। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে কবি’র জন্য দরখাস্ত রইল যেন কবি সুখে থাকেন।
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি ‘সোনালি কাবিন’ খ্যাত কালজয়ী কবি আল মাহমুদ। সাহিত্যে নিজের অমরতা নিশ্চিত করে বসন্ত-ভালোবাসার আবেশ গায়ে মেখে তিনি​ ১৫ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিয়েছেন এ পৃথিবী থেকে। তিনি আর কখনো আসবেন না লোকালয়ে, অমর একুশে বইমেলায়। আসবেন না সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আশীর্বাদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য কবি আল মাহমুদ। পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত সাহিত্যের সব্যসাচী কবি আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, আত্মজীবনী ইত্যাদি। এ যাবৎ তার প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’।
বাংলা কবিতায় গ্রামীণ এবং নাগরিক চেতনার মিশেলে এক নতুন ধারা রচনা করে গেছেন আল মাহমুদ। ছন্দের চালে কীভাবে আধুনিক হৃদয়কে বশ করতে হয় তা শিখিয়ে গেছেন তিনি। তার কিশোর কবিতা আবহমান বাংলাকাশে চিরকাল শিশির হয়ে ঝরবে।’
‘আল মাহমুদ শনাক্ত হয়েছেন তার কবিতায়। চর্যাপদের কাল থেকে প্রকৃত কবিরা যেভাবে শনাক্ত হয়ে এসেছেন কালে কালে তিনিও সেভাবেই শনাক্ত হয়েছেন এবং কালের অমর পাতায় তার কীর্তি লিপিবব্ধ হয়ে থাকবে সোনালী কালিতে এটাই বাস্তব।’
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’। এর তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আরো দু’টি কবিতার বই ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’। এর মধ্যে ‘সোনালি কাবিন’ তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এ ছাড়া তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ তার উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপা হওয়ার কারণে ফেরারি হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথেও।
নিজের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা রচনা করে গেছেন কালজয়ী দু’টি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’।
তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রাক্তন এই সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক সহায়তায় যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে।
সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আল মাহমুদ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ উল্লেখযোগ্য। নিজের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির কারণে আল মাহমুদ জীবনব্যাপী মানুষের হৃদয়ে আর ইতিহাসের শিলালিপিতে যে অমরতা পেয়েছেন, কোনো স্বীকৃতিই তার সাথে তুল্য নয়।
আল মাহমুদ প্রাণহীন হলেও নিজ কীর্তির কারণে প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে আছেন। প্রভাতফেরি, আধফালি চাঁদ, নারী, নিসর্গ, ফুল-পাখি বা খড়ের গম্বুজের আড়ালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে। আর খুঁজলেই পাওয়া যাবে তার কবিতা ও বই।
আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়। বাংলা ভাষা এবং বাংলা কবিতা যতদিন থাকবে ততদিন শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে ‘সোনালী কাবিনের’ কবির নাম। কবির দীর্ঘ স্মৃতিপট বেঁচে থাকার এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তার উত্তরসূরি কবিরা। অভাববোধ করেন অনুজ স্নেহের কবি’রা। স্মরণসভা, জন্মদিনসভা কবিতা আড্ডা দিয়ে কবিকে জিইয়ে রাখার চেষ্টায়,মগ্ন তারা।
‘আল মাহমুদ কবিতার মানুষ ছিলেন। তার কাছে কবিতাই ছিল মুখ্য। রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন এটা সত্য তবে তিনি চিরকালই তার কবিতার আদর্শে অটুট ছিলেন। যে কবি যত বেশি আলোচনায় থাকেন তিনি তত বেশি সফল।’
‘কোনো বিভাজন কবিকে স্তব্ধ করে রাখতে পারে না। একজন কবি’র যাত্রা কাল এবং সময়কে অতিক্রম করে এগিয়ে চলে অনন্তের পথে। আল মাহমুদ সেই যাত্রী যিনি শেষ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন তার কবিতা দিয়েই, অন্য কিছু দিয়ে নয়।’ কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, ‘আল মাহমুদ সহজ সরল শব্দ এবং বাক্য দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে তাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব বিভাজন থাকলেও ওপার বাংলায় তিনি এককভাবে উচ্চারিত। এটাই কবি আল মাহমুদের সাফল্য।’
শুভ কামনা কবি।অনন্ত জীবনে সুখে থাকুন।
অ আ আবীর আকাশ: লেখক কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
সম্পাদক: আবীর আকাশ জার্নাল